শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম,
প্রিয় পাঠক- আসসালামু আলাইকুম, বাংলাদেশে নবান্নের নতুন ধানের পিঠা পুলি শীতের এক ঐতিহ্যবাহী উৎসব এবং তখন গ্রাম বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে এক আনন্দঘন পরিবেশ বিরাজ করে। তাছাড়া শহরেও সমভাবে জনপ্রিয় এটি।
নতুন চালের গুড়ো, নারকেল এবং খেজুরের গুড় দিয়ে বিভিন্ন ধরনের পিঠা যেমন- পাকন পিঠা, ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, নকশী পিঠা ইত্যাদি আরো নানান রকমের মজাদার ও সুস্বাদু পিঠা তৈরি হয়। তাই আজকে আমাদের আলোচনা বিষয় হলো- ‘শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য’।
পেজ সূচিপত্রঃ শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
- শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
- পিঠা পুলির আদি কথা সম্পর্কে জেনে নিন
- শীতের নানান রকম পিঠা পুলির নাম জানুন
- পিঠা পুলির স্বাদ ও তাদের নামের বিশেষত্ব
- শীতকালীন পিঠা পুলির উৎসব
- শীত ও পিঠা পুলি একে অপরের পরিপূরক
- শীত মানেই গ্রাম বাংলার মানুষের পিঠা পুলি খাওয়ার ধুম
- শহরেও গ্রামের কিছু জনপ্রিয় পিঠা পুলি অহরহ পাওয়া যায়
- প্রশ্ন ও উত্তরঃ শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
- পোস্টের ইতি-কথাঃ শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
আমাদের দেশে প্রতি বছর শীতকালর শুরু থেকেই নানারকম সুস্বাদু পিঠা পুলি
বানানো খাবার এক উৎসব তৈরি হওয়া প্রতি ঘরে ঘরে। তবে আগের মতন এখন আর তেমনভাবে
শীতের পিঠা বানানো চোখে পড়ে না অর্থাৎ দিনে দিনে এই শীতকালীন পিঠা পুলির -
খাওয়ার ধুম অনেকটাই কমে গেছে।
বিশেষ করে, গ্রাম অঞ্চলের মানুষ এখনো শীতকালীন সুস্বাদু পিঠা পুলির আনন্দ, উৎসব,
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য কিছুটা হলেও ধরে রেখেছে।
আগে দিনে যেরকম মায়ের হাতের বিভিন্ন স্বাদ ও নকশার পিঠা আর সেই পিঠাগুলোর পেছনে ইতিহাসের গল্প শোনা অথবা ধোঁয়া উঠা গরম চিতই পিঠার সঙ্গে মাংসের ঝোল দিয়ে মজাদার নাস্তা এখন আর সেরকম চোখে পড়ে না।
এখনকার সময়ে শীতকালে শহরের বিভিন্ন ফুটপাতে, ঠেলাগাড়িতে বা ভ্যানে করে বিভিন্ন
রকম পিঠা পুলি বিক্রি করতে দেখা যায়।
আরো পড়ুনঃ শীতকালে শিশুর ত্বকের সঠিক পরিচর্যায় করণীয় কি কি?
পিঠা পুলির আদি কথা সম্পর্কে জেনে নিন
সংস্কৃত ‘পিষ্টক' শব্দ থেকে 'পিঠা' শব্দটি এসেছে।আবার ‘পিষ্টক’ শব্দটি এসেছে ‘পিষ্' ক্রিয়ামূলে তৈরি হওয়া শব্দ ‘পিষ্ট' থেকে৷ পিষ্ট অর্থ চূর্ণিত, মর্দিত, দলিত। হরিচরণ বন্দোপাধ্যায় বঙ্গীয় শব্দকোষ বইয়ে লিখেছেন, “পিঠা হলো চাল গুঁড়া, ডাল বাটা, গুড়, নারিকেল ইত্যাদির মিশ্রণে তৈরি মিষ্টান্নবিশেষ।” বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যশষ্য ধান৷ ধান থেকে চাল এবং সেই চালের গুঁড়ো পিঠা তৈরির মূল উপাদান।
বিশাল ভারতীয় উপমহাদেশে বসবাস করা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যেও পিঠা যে জনপ্রিয় খাবার সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে এর প্রচলন শুরু হয় আনুমানিক ৫০০ বছর আগে থেকে। তাই বাঙালির লোকজ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে- পিঠা পুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে আদিকাল থেকেই।
তাছাড়া আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠা পুলির উৎসব বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে।
হেমন্ত কাল বা ‘নবান্নের’ পর জাঁকিয়ে শীত পড়লে পৌষ সংক্রান্তিতে পিঠা পুলি তৈরির আয়োজন করা হয়।তারপর বসন্তের আগমন পর্যন্ত চলে হরেকরকম পিঠা খাওয়ার ধুম।
এ সময় অতিথি বিশেষ করে জামাইদের দাওয়াত করে পিঠা পুলি খাওয়ানো হয়। আর খেজুরের রস থেকে গুড়, পায়েস এবং নানারকম মিষ্টান্ন তৈরি হয়। খেজুরের রসের মোহনীয় গন্ধে তৈরি পিঠা-পায়েস আরও বেশি মধুময় হয়ে ওঠে।
শীতের নানান রকম পিঠা পুলির নাম জানুন
শীতের নানান রকম পিঠা পুলির মধ্যে জনপ্রিয় কিছু নাম উল্লেখ করা হলোঃ
- ভাপা পিঠা
- পাটিসাপটা পিঠা
- চিতই পিঠা
- পুলি পিঠা
- নকশী পিঠা
- ক্ষীরপুলি
- কলা পিঠা
- চাপড়ি পিঠা
- মুঠি পিঠা
- খেজুর পিঠা
- ম্যারা পিঠা
- ছিট পিঠা
- দুধপুলি
- তিলপুলি
- পয়সা পিঠা
- নারু পিঠা
- বিস্কুট পিঠা
- নুডুলস পিঠা
- সেমাই পিঠা
- তালের পিঠা
- তেলে ভাজা পিঠা
- ফুলঝুড়ি
- ডিমের ঝাল পুয়া পিঠা
- ধুপি পিঠা
- মালাই পিঠা
- মালপোয়া
- পাক্কন পিঠা
- শুঁটকি পিঠা
- সিদল পিঠা
- চুঙ্গা পিঠা
- ঝাল পিঠা ইত্যাদি।
পিঠা পুলির স্বাদ ও তাদের নামের বিশেষত্ব
অধিকাংশ পিঠা পুলি মিষ্টি জাতের হয়ে থাকে। তবে এদের স্বাদ ও মজা ভিন্ন ভিন্ন হয়। তাছাড়া, এসব পিঠা পুলি কেবলমাত্র স্বাদই নয়, নামেও এদের বিশেষত্ব রয়েছে। যেমন-
- দুধে ভিজে চিতই হয় দুধ চিতই
- লবঙ্গের ঘ্রানে সাজে লবঙ্গ লতিকা
- গরম ভাপে তৈরি ভাপা পিঠা
- সুন্দর নকশা আঁকা হয় বলে নকশী পিঠা
- মুঠ পাকিয়ে সেদ্ধ দিলেই মুঠোপিঠা
- গোলাপ ফুলের আকারে হল গোলাপ পিঠা ইত্যাদি।
প্রতিটি পিঠা শুধু স্বাদেই অনন্য নয়, এদের এক একটি উপকরণে পরম মায়ার পরশ মাখা থাকে।নারকেল কুড়ানো, কুয়াশার ভোরে সংগ্রহ করা খেজুর রস আর সেই নতুন রসের থেকে তৈরি পাটালি গুড় আর খাঁটি ঘন দুধ, তেল ইত্যাদি সব উপকরণের সাথে মায়ের যত্ন আর ভালোবাসা মিশিয়ে বানানো- অমৃত স্বাদ ও মজাদার পিঠা পুলি খেতে কতই না আনন্দ লাগে।
খেজুরের রসে তৈরি নানা প্রকার পিঠা-পায়েস গ্রাম-বাংলার মানুষের নবান্নের সেরা উপহার। পিঠা আর খেজুরের রস একটি আরেকটির পরিপূরক যা বাঙালি ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে।
শীতকালীন পিঠা পুলির উৎসব
বাঙালির লোকজ সংস্কুতি-ঐতিহ্যে পিঠা পুলি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে আদিকাল থেকেই। এক সময় সোনার বাংলায় যেমন নানান নামের ধান ছিল, তেমনি সেসব ধানের পিঠারও অন্ত ছিল না। পিঠা তৈরি ছিল আবহমান বাংলার মেয়েদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য। পিঠা-পায়েসকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে এখনও অসংখ্য গান-কবিতা ও ছড়া প্রচলিত।
আত্মীয়স্বজন ও পারস্পরিক সম্পর্কের বন্ধন আরও দৃঢ় ও মজবুত করে তুলতে পিঠাপুলির উৎসব বিশেষ ভূূমিকা পালন করে। গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে পিঠা-পায়েস তৈরির ধুম শীতকালেই বেশি পড়ে।
তাই পিঠাকে কেন্দ্র করে বিখ্যাত কবি বেগম সুফিয়া কামাল লিখেছেন, ‘পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসি খুশিতে বিষম খেয়ে/ আরও উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে।'
আরো পড়ুনঃ শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় করণীয় - বিস্তাারিত আলোচনা
শীত ও পিঠা পুলি একে অপরের পরিপূরক
শীত ও পিঠা পুলি একে অপরের পরিপূরক কারণ, শীতকাল এলেই আমাদের দেশের গ্রামাঞ্চলে নবান্নের নতুন ধান ওঠেে এবং খেজুরের রসও এসময় পাওয়া যায়। মূলত এই উপকরণগুলো দিয়ে বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন পিঠা যেমন: ভাঁপা পিঠা, নকশী পিঠা, পাটিসাপটা, চিতই পিঠা, পাক্কন পিঠা ইত্যাদি তৈরির ধুম পড়ে যায়, যা শীতের সকালে বা সন্ধ্যায় গরম গরম খাওয়া এক অনন্য অভিজ্ঞতা দেয় এবং এটি বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিচিত।
শীতের হিমেল ঠাণ্ডা হাওয়া আর পিঠার উষ্ণতা, এই দুইয়ের মেলবন্ধনই বাঙালি জীবনে এক বিশেষ আমেজ ও উৎসব নিয়ে আসে, তাই এদেরকে একে অপরের পরিপূরকও বলা হয়ে থাকে।
শীত মানেই গ্রাম বাংলার মানুষের পিঠা পুলি খাওয়ার ধুম
আমাদের দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন উৎসবে পিঠাপুলির আয়োজন দেখা গেলেও পিঠা খাওয়ার আসল মৌসুম কিন্তু শীতকালেই। শীতে নতুন ধানের নতুন চাল এবং খেজুরের রসের নতুন গুড়ে ঠাসা পিঠা পুলি গ্রাম বাংলার জীবনকে করে তোলে রঙিন, উৎসবমুখর ও আনন্দময়।
যেহেতু আমাদের দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হলো- ধান, তাই চালের গুঁড়া পিঠা তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহার হয়। এছাড়া পিঠা তৈরির আরো অন্যান্য উপকরণের মধ্যে রয়েছে- ময়দা, নারিকেল, খেজুরের রস, খেজুরের গুড়, আখের গুড়, দুধ, তেল, চিনি ইত্যাদি। আবার কখনও কখনও সবজি ও মাংস পিঠা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে উপরে উল্লেখিত নানান রকম ঐতিহ্যবাহী নাম জানা- অজানা পিঠা ছড়িয়ে আছে। অঞ্চল ভেদে পিঠার নাম ভিন্ন হয়ে যায় এব এটি তৈরিতেও আসে ভিন্নতা। শীতকালে সবখানেই পিঠামেলা বা পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয় থাকে।
শহরেও গ্রামের কিছু জনপ্রিয় পিঠা পুলি অহরহ পাওয়া যায়
শীতকালে শহরেও গ্রামের কিছু জনপ্রিয় পিঠা পুলি অহরহ পাওয়া যায়। শহর এলাকার বিভিন্ন ফুটপাত, জনবহুল এলাকা, বিভিন্ন টার্মিনালে পিঠা বিক্রির ধুম পড়ে যায়। সন্ধ্যার পর হরেক রকম পিঠার স্বাদ আর গন্ধ মুগ্ধ করে নগরবাসীকে। যেমন- ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা, মালপোয়া ইত্যাদি। বিশেষ করে শহরে ভাপা পিঠা বিক্রি শীতে বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে।
শহরে যাদের বসবাস আর জীবন যাত্রার ব্যস্ততার কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘরে বানানো পিঠা খেতে পারেন না তারা। তাই জীবিকার জন্য যারা শহরে এসে রিকশা, অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত গাড়িসহ শ্রমিকের কাজ করছেন তারাও পরিচিত পিঠার এসব দোকানে ভীড় জমাচ্ছেন।
ফাস্টফুড সংস্কৃতির এই যুগেও শীতের গরম পিঠার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। শহরে বসেও গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই খাবার (পিঠা পুলি) উপভোগ করার সুযোগ হাতছাড়া করতে চান না অনেকে। এসব দোকানে পাঁচ টাকায় চিতই, তেলের পিঠা ও পাঁচ থেকে দশ টাকায় ভাপা পিঠা পাওয়া যায়। চিতই পিঠার সঙ্গে সর্ষে, ঝাল ও শুঁটকি ভর্তার পাশাপাশি আট থেকে দশ ধরনের ভর্তা পাওয়া যায় ফ্রিতে।
তাছাড়া বিভিন্ন রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেগুলোতেও এখন নানা ধরনের পিঠার আয়োজন করা হয়, যা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মিশেলে এক ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়।
প্রশ্ন ও উত্তরঃ শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
- ভাপা পিঠা
- পাটিসাপটা পিঠা
- চিতই পিঠা
- পুলি পিঠা
- নকশী পিঠা ইত্যাদি।
পোস্টের ইতি-কথাঃ শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য
পরিশেষে, ‘শীতে সুস্বাদু পিঠা পুলির উৎসব যা বাংলার ঐতিহ্য’ শিরোনামের এই আর্টিকেলটি আলোচনা করে আমরা বলতে পারি যে, শীতের আয়োজনে সত্যিই এমন ধরণের পিঠা পুলি গুলোকে ধনী কিংবা গরীবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় না করে সবার মাঝে সাধ ও সাধ্যের মধ্যেই যেন রসনা বিলাস করে আসছে। গ্রাম বাংলার মানুষের এমনই জীবন সত্যিই নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশ ও তাদের এই উৎসব বাঙালী জাতির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বহন করে। অর্টিকেলটিতে ভুলত্রুটি হলে ক্ষমা সুন্দরদৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে।




গ্রো কেয়ার আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url